আজকের গণমত ডেস্কঃ বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের এক নম্বর সমস্যা কী? এই প্রশ্ন যত জন বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছি তারা সবাই বলেছেন খেলাপি ঋণ৷ বিশেষজ্ঞ কেন, সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করলেও একই জবাব পাওয়া যায়৷
তারা মনে করেন, সাধারণ মানুষের টাকা লুটপাটের সহজ উপায় হলো ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা নেয়া এবং ফেরত না দেয়া৷
বিশ্লেষকেরা এটাকে বলছেন টাকা লোপাটের আনুষ্ঠানিক কৌশল৷ আর দেশের এই অর্থ যারা লুট করেন তারা সেটা আবার পাচার করে দেন দেশের বাইরে৷ কিন্তু এর জন্য থাকতে হবে রাজনৈতিক ক্ষমতা, হতে হবে সপরিবারে ব্যাংকের পরিচালক অথবা থাকতে হবে প্রভাবশালী ও শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক৷
এই সময়ে ব্যাংকের তারল্য সংকট, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে ব্যাংক চালানো, প্রবলেম ব্যাংক এই সবকিছুর মূলে রয়েছে এই খেলাপি ঋণ৷ কারণ এখান থেকেই সব সংকটের উৎপত্তি৷ ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমানতের বিপরীতে কম সুদ দিচ্ছে৷ আর গ্রাহকরা সেই কারণে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছেন৷ যা থেকে আসছে তারল্য সংকট৷ তারও মূলেও এই খেলাপি ঋণ৷ কারণ খেলাপি ঋণের যে ক্ষতি তা কম সুদ দিয়ে পুষিয়ে নিতে চায় ব্যাংক৷ একই সঙ্গে এই পরিস্থিতি ব্যাংকে আস্থার সংকট তৈরি করে৷ বাংলাদেশে এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ লাখ ২০ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা৷
সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন খেলাপি ঋণ ছিলো ২২ হাজার কোটি টাকা৷ এখন সেটা এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে৷ এর মূল কারণ ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব৷ এখানে সত্যিকারের ঋণখেলাপি আর ইচ্ছকৃত ঋণখেলাপি আলাদা করা হয়নি৷ যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন তাদের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি৷’’
তার কথা,‘‘ব্যাংক খাতে যে সংস্কার করার কথা ছিল তা করা হয়নি৷একই পরিবারের চারজন একটি ব্যংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকতে পারছেন৷ আগে ছিলো সর্বোচ্চ দুইজন৷ আর আগে পরিচালকরা সর্বোচ্চ ৯ বছর থাকতে পারতেন সেটা বাড়িয়ে ১২বছর করা হয়েছে৷’’
‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো ব্যাংকগুলোর অভিভাবক ৷ আমরা দেখছি তাদের নজরদারি ঠিকমতো হয় না৷ বছরের পর বছর ঋণের এই খেলাপি চলছে৷ কিন্তু কোনো সুরাহা হচ্ছে না৷ আমরা কমিশন করে রিপোর্ট দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য বলেছি৷ কিন্তু হচ্ছে না,’’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ৷
গত জুনের হিসাব বলছে বাংলাদেশের ১১টি ব্যাংক ব্যাংকে মোট ৩৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি রয়েছে৷ এসবের মধ্যে আছে কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক৷ এর পাঁচটি ব্যাংকই হলো রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক৷ গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবলেম ব্যাংক হিসেবে ১০টি ব্যাংককে চিহ্নিত করে৷ যদিও নাম প্রকাশ করা হয়নি৷ এরপর এই ধরনের নয়টি দুর্বল ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক৷
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম আর লুটপাটের সর্বশেষ উদাহরণ ইসলামী ব্যাংক৷ পরিস্থিতি সামলাতে তাই ইসলামী ব্যাংকের শাখাগুলোর ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে৷ মন্দার মধ্যেই গত বছর ইসলামী ব্যাংকে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে৷ এস আলম গ্রুপ একাই ওই ব্যাংক থেকে নিয়মের তোয়াক্কা না করে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়৷ এস আলম গ্রুপের কর্ণধারেরাই আবার ব্যাংকটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত৷ ব্যাংকটিকে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ধার দিয়ে সচল রাখাছে৷ ইসলামি ধারার আরো কিছু ব্যাংক এখন সংকটে রয়েছে৷ ইসলমি ব্যাংকসহ শরিয়া ভিত্তিক ছয়টি ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে জরিমানা দিচ্ছে প্রতিদিন৷ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে না পারায় তাদের এই জরিমানা গুণতে হচ্ছে৷ ইসলামী ব্যাংক ছাড়া অন্য পাঁচটি ব্যাংক হলো: সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক৷ এর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন৷ এসব ব্যাংক গত বছরের ডিসেম্বর থেকে তারল্য ঘাটতিতে রয়েছে৷
ব্যাংকের টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে অবৈধ উপায়ে৷ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র এই ব্যাংকগুলো দুর্বল হওয়ায় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব পড়ছে৷ বিনিয়োগ বাড়ছে না৷ ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে না৷
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন,‘‘ব্যাংককে হতে হবে ব্যবসায়ী বান্ধব৷ তারা যদি ব্যবসায়, শিল্পে সহায়তা করে তাহলে এই খাত শক্তিশালী হবে৷ অর্থনীতি লাভবান হবে৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা কাজ করে বা করতে বাধ্য হয়৷ ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়ছে৷ ব্যাংকগুলো দুর্বল হচ্ছে৷ যারা খেলাপি ঋণের নামে ব্যাংকের টাকা লুটে নিচ্ছে, দেশের বাইরে পাচার করছে৷ তা