বরগুনা প্রতিবেদকঃ
বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক
ডিমও ঘুস নেন বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক। ঘুসের তালিকায় আছে পাতিহাঁস, গরু-ছাগলও। সম্প্রতি এলাকার চিহ্নিত অপরাধীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কয়েকটি ছবি ভাইরাল হলে তার বিষয়ে একটি বিশেষ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। এছাড়া এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি মহিলা কনস্টেবলদের আবাসিক ব্যারাকে গিয়ে নাচের প্রশিক্ষণ উপভোগ করেন। যেখানে অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। চালু করেছেন বিশেষ ব্যায়ামাগার, যা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসপি মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। জেলা পুলিশ সদস্যদের একটি কালচারাল সংগঠন আছে। সেখানে মহিলা কনস্টেবলরা নাচের রিহার্সেল করেন, যা দেখার জন্য পুলিশ সদস্যদের অনেকেই যান। আমিও গিয়েছি। কিন্তু শুধু আমি যে একমাত্র গিয়েছি, এমন অভিযোগ সত্য নয়। কারণ একা দেখাটা নাজায়েজ কাজ।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বড় খানার নামে বিভিন্ন থানা থেকে মাছ, মাংসসহ টাকা নেওয়া ও বদলি করে টাকা নেওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। এগুলো ভুয়া অভিযোগ। কে বা কারা এসব নাজায়েজ অভিযোগ করল বুঝতে পারছি না।’
বিশেষ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এই পুলিশ সুপারের ব্যক্তিগত দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ‘আমতলী থানা পরিদর্শনের সময় ডিমও ঘুস নিয়েছেন এই এসপি। উৎকোচের তালিকায় আছে পাতিহাঁসও। চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে বিনামূলে নিয়েছেন ৯টি গরু, যা তিনি সম্প্রতি সাড়ে ৪ লাখ টাকায় বিক্রিও করেছেন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বরগুনা পুলিশ লাইনের হলরুমে বড় খানার আয়োজন করেন এসপি। এ উপলক্ষ্যে সদর পুলিশ থানা থেকে ৭০ কেজি গরুর মাংস, আমতলী থানা থেকে ৫০ কেজি গলদা চিংড়ি, পাথরঘাটা থানা থেকে ৬০ কেজি ইলিশ, তালতলী থানা থেকে ১৫ হাজার টাকা, বামনা ও বেতাগী থানা থেকে ১০ হাজার টাকা গ্রহণ করা হয়। কর্মস্থলে বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ সস্যদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধাও নিয়ে থাকেন তিনি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি এসপি জাহাঙ্গীর মল্লিক মাসিক অপরাধ দমন সভায় বসে বরগুনার ৬টি থানার ওসির কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা উৎকোচ নিয়ে থাকেন। পুলিশ লাইন্স রিজার্ভ অফিসের পেছনে টেনিস মাঠ, ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠ ঠিক করেছেন ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে টাকা এনে। এছাড়া বরগুনাস্থ পুলিশ বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর মল্লিক একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্থ আদায় করেন। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্যদের মধ্যে অপরাধ শাখার অফিস রিডার আতিকুর রহমান পুলিশ সুপারের ভাগনে হিসাবে পরিচিত। এ চক্রের বাকি দুজন হলেন রেশন স্টোরের ইনচার্জ এসআই মো. খলিলুর রহমান ও কনস্টেবল মো. লিটন হোসেন।
এদিকে ওয়ারেন্ট তামিলে বরাবরের মতোই ব্যর্থ বরগুনার পুলিশ সদস্যরা। এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় কৈফিয়ত তলব করেন এসপি। গত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭ মাসে ওয়ারেন্ট তামিলে ব্যর্থ ও মামলার তদন্তে অগ্রগতি বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করে নিরস্ত্র এসআই ও এএসআইদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা হারে ৭০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। অপরাধ শাখার রিডার আতিকুর রহমান কৈফিয়ত তলবের অফিস কপিতে ডিসপ্যাচ রেজিস্ট্রারের স্মারক ব্যবহার না করে ভুয়া ও বানোয়াট স্মারক ব্যবহার করতেন। অক্টোবর থেকে এমন কার্যক্রম বন্ধ আছে। থানা এবং জেলা গোয়েন্দা শাখার অফিসার ফোর্সরা সোর্সমানির টাকা পান না। এসব বিষয়ের পাশাপাশি বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত আছেন জাহাঙ্গীর মল্লিক।
কোন থানা থেকে কতজনকে, কত টাকা নিয়ে পোস্টিং অর্ডার করেছেন তাদের নাম ও ঘুসের পরিমাণসহ বিস্তারিত তথ্য রয়েছে এই প্রতিবেদনে। এভাবে এসপির ঘুস লেনদেনের দীর্ঘ ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে ৭ পৃষ্ঠার গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এর এক স্থানে এসপির নৈতিক স্খলনের ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়, এসপি জাহাঙ্গীর মল্লিক পুলিশ লাইন্সের মহিলা ব্যারাক ভবনের নিচতলার হলরুমে গত মার্চ মাসে বিনোদনকেন্দ্র তৈরি করেন। ৬ জন মহিলা কনস্টেবলের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, এসপি ওই বিনোদন কক্ষে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তাদের নিয়ে নাচ শেখার প্র্যাকটিস করতেন। রাজকীয় স্টাইলে এসপি সোফার ওপর বিশেষ ভঙ্গিতে শুয়ে থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তা উপভোগ করতেন। তবে এই নাচের অনুষ্ঠানে দর্শক মাত্র একজনই থাকতেন। তিনি হলেন এসপি জাহাঙ্গীর। ২/৩ ঘণ্টাব্যাপী এই নাচগান পর্ব চলাকালে সেখানে কোনো অফিসার, ফোর্স ও দেহরক্ষীর প্রবেশের অনুমতি ছিল না। কিন্তু এই নাচ অনুষ্ঠানের গোপন রহস্য ফাঁস হয়ে গেলে সেটি বেশিদিন আর চালাতে পারেননি। গত জুলাই থেকে বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে বিশেষ নাচানাচির এই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও মহিলা পুলিশ ব্যারাকের দ্বিতীয় তলায় ব্যায়ামাগারটি তিনি চালু রেখেছিলেন। প্রতিদিন ভোর ৫টার দিকে হাঁটতে বের হয়ে ওই ব্যায়ামাগারে যেতেন। সেখানে সকাল ৮টা পর্যন্ত অবস্থান করতেন। এ সময়ও ব্যায়ামাগারের আশপাশে কেউ যেতে পারতেন না। যদিও ওই ব্যায়ামাগারে কোনো পুরুষ পুলিশ সদস্যের প্রবেশের অনুমতি ছিল না।